পলাশীর যুদ্ধ অতঃপর প্যারী সুন্দরীর বাংলাদেশ
লালিম হক
দুরন্ত পদ্মার আনন্দ প্রবাহিণী সহচরী গৌড়ী বা গড়াই। গড়াই নদীর মনোরম শ্যামল বিস্তীর্ণ এঁটেল মাটির স্নিগ্ধ পল্লী রবিতীর্থ শিলাইদহ, আর গড়াই নদীর পার ঘেঁষে প্রাচুযে ভরপুর বধিষ্ণু গ্রাম ‘কয়া’ যেখানে জন্মেছিলাম সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)। কয়ার চণ্ডতলার চাটুজ্যেরা ছিলেন বাঘা যতিনের মামা। গড়াই নদীর দক্ষিণ পাড়ে ছোট্ট শহর কুষ্টিয়া। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বিশাল সময় জুড়ে কলকাতার কথিত নবজাগরণের আলোকচ্ছটার বিচ্ছুরণ সীমার বাইরে তৎকালীন নদীয়া জেলা ছিল একটু ভিন্ন মাত্রিক বোধসম্পন্ন সচেতন জনগোষ্ঠীর লীলাভূমি। আর এই মহকুমার বিদগ্ধ জনসমাজ বিপ্লবের অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পীড়িত মানুষের স্বার্থে নিজের শ্রম, মেধা ও অর্থ দেশপ্রেমের জন্য উৎসর্গ করেছিলন। মাথা তুলে বীরের মত দাঁড়িয়েছিলেন স্বমহিমায়। তাঁদের মধ্যে একজন নারীর নাম প্যারী সুন্দরী ‘ইংরেজ তাড়াও’ আন্দোলনে চিরস্মরণীয়। স্মরণ করি পশ্চিমবাংলা মেদিনীপুর জেলার বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার কথা। তাঁর সেই অসামান্য আত্মবলীদানের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত একমাত্র পঞ্চদশ শতাব্দীর ফরাসি বীরাঙ্গনা ‘জোয়ান অব আর্ক’ এর সঙ্গে তুলনীয়। আর একজন নারী ভারতবর্ষে জন্মেগ্রহণ না করেও ভারতবর্ষকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম ‘নেলী সেনগুপ্তা’। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য নেলী সেনগুপ্তার আত্বত্যাগ স্মরণযোগ্য। দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে নেলী সেনগুপ্তা পদবী গ্রহণ করেন। নেলী মূলত ‘আইরিশ’। যখন মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা দখল করলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার ও সমস্ত প্রধান সরকারি কার্যালয়। তখন উর্দ্ধতন ইংরেজ কর্মকর্তারা পালিয়ে গেল বিভিন্ন উপায়ে। ঠিক এক বছর পর বীর কন্যা প্রীতিলতার নেতৃতে¦ বিপ্লবীরা আক্রমন করলেন পাহাড়তলীর ইংরেজদের ক্লাব। শহিদ হলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। আমরা মূলত ভারতবাসী। আমাদের আছে আবহমান কালের লোকায়ত ধর্মবিশ্বাস, আছে আর্য অনার্যের দ্বান্দ্বিক নন্দিত বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আছে আনন্দ উৎসব গভীর বেদনার মর্মান্তিক দুঃখের উপাখ্যান। আমাদের অতীত ইতিহাস ঐশ^র্যলোলুপ নরপশুদের আক্রমণের কাহিনিতে ভরপুর। সর্বোপরি আমরা আত্মবিস্তৃত লাঞ্চনার ধিক্কারে পাথরপ্রায় একটি শংকর জাতি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তরুন যুবক সিরাজোদ্দৌলা যখন বাংলা বিহার উরিষ্যার মসনদে অধিষ্ঠিত সেই মুহূর্তে সেনাপতি মীর জাফর আলী খান ইংরেজদের সহযোগিতায় নিজে নবাব হওয়ার যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে এদেশে ইংরেজ রাজতে¦র সূচনা। যে ব্যক্তি নিজে ক্ষমতার জন্য আপন দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারেন, তাকে সংগত কারণেই সেদিন ইংরেজরা বিশ্বাস করতে পারেননি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ। মূলত পলাশী যুদ্ধে প্রহসন, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছলচাতুরির আশ্রয়ে নবাব সিরাজোদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজ শাসকরা ভারতে সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। এরপর থেকেই আমাদের গ্লানির আর লজ্জার দুইশত বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। পলাশীর প্রান্তরের পরাধীনতার যে বীজ সেদিন রোপিত হয়েছিল,তা কালক্রমে বিরাট মহীরুপে পরিণত হলো। বাংলা তথা সারা ভারতের উপনিবেশ পরিমন্ডল উপেক্ষা করেও এদেশের আধ্যাত্মবাদের প্রভাব এখনও পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তারই সূত্র ধরে গেয়ে উঠেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ আর উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থে বাউল সম্রাট লালন সাইঁ, কাঙ্গাল হরিনাথ, অতুল প্রসাদ, দীলিপ রায়, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম আরও অসংখ্য বাংলার বাউল, বৈষ্ণব। মুকুন্দ দাসের মতো অসংখ্য চারণেরা গ্রামগঞ্জে জনপদে গেয়ে চলল জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও প্রেরণাদীপ্ত সঙ্গীত। এই চারণ কবিয়ালদের গান আর বিদ্রোহের ঐক্যতানে সিরাজোদ্দৌলার পতনের পর সংঘঠিত হয় বাংলার অসংখ্য বিদ্রোহ, সেই মানসে প্রভাবিত হয়ে বঙ্কিম চাটুজ্যে ‘আনন্দমঠ’ লিখলেন। পরবর্তীকালে নদীয়া জেলায় মোল্লাহাটি নীল কনসার্নের নীলকরের অত্যাচারের কাহিনি অবলম্বনে নদীয়ার চৌবারিয়া গ্রাম নিবাসী বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ‘নীল দর্পন’ নাটক লিখলেন। আর একজন অবাঙালি হয়েও সখারাম গণেশ দেউস্কর ‘দেশের কথা’ লিখে বাঙালির স্বাধীনতার অর্জনে সহায়তা করলেন। ক্রমশ শুরু হয়ে গেল ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে অগ্নিবারুদ বিদ্রোহের রক্তঝরা স্বাধীনতার সংগ্রাম। চতুর ষড়যন্ত্রকারী বেনিয়া ইংরেজ ১৭৬৩তে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে মসনদেথেকে বিতাড়িত করে মীর কাশিমকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করান। স্বাধীনচেতা মীর কাশিমই ভারতে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের প্রথম অগ্নিমশাল জ্বালালেন। মসনদে মীর কাশিম উপবেশন করে অনুধাবন করলেন যে সমগ্র বাংলায় কৃষকসমাজ, তাঁতি, বণিক, হিন্দু- মুসলমান ইংরেজ কোম্পানিওয়ালাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। বকসারের যুদ্ধে মীর কাশেম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লির পলাতক বাদশাহ শাহ আলমের সেনাদল পরাজিত হলো ইংরেজদের কাছে। কিন্তু হার মানলেন না কেবল মীর কাশেম। অনেক কষ্টে দুঃখে ১৭৭৭ সালে মারা যান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহান সৈনিক।
রাজশাহী, পাবনা ও নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার ৩টি অঞ্চলে বিংশ শতাব্দীর ২য় দশকে এক বিস্ময়কর কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে ওঠে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এই সংগ্রামের নেতৃত্বেও পুরোভাগে ছিলেন একজন রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের বিধাব মহিলা কুষ্টিয়া মহকুমার আমলা সদরপুর জমিদার স্টেটের কিংবদন্তী ও বিখ্যাত বীরকন্যা প্যারী সুন্দরী। হিন্দু মুসলিম কৃষক প্রজা নীলকর সাহেব কেনির অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে অবশেষে প্যারাসুন্দরী দেবীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। প্যারাসুন্দরী প্রজাদের পক্ষে দাঁড়ালেন অকুতোভয়ে, মহিলা হওয়া সত্বেও। কেনি সাহেবের শোষণ অত্যাচার ও নৃশংসতা ধৈর্য্যরে সীমা ছাড়িয়ে গেলে ও বহু আবেদন, নিবেদন করা সত্বেও রাজশক্তির কোনো প্রকার সহায়তা পেলেন না প্রজারা, বরং সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে নীলকর সাহেব কেনি, সদরপুরের জমিদার কাছারি বাড়ির সামনে ঘোড়ায় চড়ে এসে আস্ফালন করে নির্লজ্জ ভাষায় চিৎকার করে বললেন-‘বেওয়াকে হ্যাম সাদি কারুংগা’। বিধাব প্যারী সুন্দরী লজ্জা ও ঘৃণাতে অন্দরে গিয়ে কামরার অর্গল বন্ধ করে দৃপ্তকণ্ঠে শুনিয়ে গেলেন-‘সাহেবের কাটামুন্ডু না দেখা পর্যন্ত আমি অনশনে থাকব ও জীবন বিসর্জন দেব।’ কী সাংঘাতিক প্রতিজ্ঞা রানীর? প্রজারা তাকে রানী বলতেন। এই খবর দাবানলের মতো সারা অঞ্চলে ছড়িয়ে গেল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হিন্দু-মুসলিম কৃষক প্রজারা সদরপুরের কাছারিবাড়িতে সমবেত হয়ে অনর্গলবদ্ধ প্যারী সুন্দরী দেবীকে আশ্বাস দিলেন, ‘মা আপনি বেঁচে থাকুন, কটা দিন, তিন দিন সময় দিন। আমরা সাহেবের মাথা কেটে আপনার পায়ের কাছে এনে দেব।’
এরফান আলী নামে এক প্রজার নেতৃত্বে সহস্রাধিক সশস্ত্র কৃষক সংগঠিত হয়ে কুখ্যাত নীলকর কেনি সাহেবের কুঠি আক্রমণ করে। হঠাৎ আক্রমণে কেনি সাহেব ঘোড়ায় চেপে দ্রুত পালিয়ে গিয়ে কুষ্টিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের শরণাপন্ন হলেন, এইভাবে সাহেব প্রাণেরক্ষা পেলেন। তখন কেনির কুঠিতে ছিলেন পুলিশ সাহেব। তিনি কেনির মতো পালাতে পারলেন না। তার মাথা কেটে জনতা সদরপুরের কাছারি বাড়িতে এসে ‘কর্তিত মস্তক’ প্যারাসুন্দরী দেবীকে উপঢৌকন দিলেন। প্রতিজ্ঞামতো প্যারাসুন্দরী কাটা মুণ্ডু দর্শন করে চারদিন নিরন্ন উপবাসের পর পানীয় গ্রহণ করলেন। প্যারা সুন্দরী দেবীর বীরত্বেও কাহিনিকথা নিচের এই কবিতার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জন্মেছে সদরপুরের বাটিতে
বাপের নাম রাখাল জগতে।
রামানন্দ বাবুর বেটি, প্যারী সুন্দরী
কোম্পানির দারোগা কেটে
করল নাম জারি।
কেনি সাহেবের মুণ্ডু কেটে
এনে দেও মোর হাতেতে।
বাপের নাম রাখল রানী জগতে।
ইটালির পর্যটক মানুচ্চি লিখেছেন-কীভাবে সুবেদারের পাইক বরকন্দাজ সাধারণ কৃষকের উপর অত্যাচার চালাত। ‘তাদের (কৃষকদের) গাছের সঙ্গে বাঁধা হত এবং ঘুষি ও কোড়া মারা হত : এক ইঞ্চি পুরু ও এক ফ্যাদম লম্বা ষাঁড়ের লেজের মতো পাকানো দড়ির নাম কোড়া। এটা দিয়ে তারা পাঁজরা ও হাড়ের বিভিন্ন । অংশ ও সারা শরীরে সর্বশক্তি দিয়ে মারত।’ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় এক ইঞ্চি গভীর দাগ বসে যেত ও চামড়া কেটে যেত। নীলকরদের বিচিত্র ধরনের অত্যাচারের কাহিনি সর্বত্র প্রায় একই ধরনের। নীলকরদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে কৃষককুল বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রাম করেছে। প্যারী সুন্দরীর সাথে নীলকর টি. আই. কেনির সশস্ত্র লড়াইয়ের কাহিনি মীর মোশাররফ হোসেন লিখিত ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ নাটকের প্রজা পীড়নের কথা বলাই বাহুল্য।
টমাস আইভান কেনি বাংলার অত্যাচারী নীলকরদেও মধ্যে সর্বাপেক্ষা লোমহর্ষক অত্যাচারী ছিলাম। কুষ্টিয়ার শালঘর মধুয়ার নীলবিদ্রোহের ফলশ্রæতিতে ব্রিটিশ সরকারকে এ অঞ্চলের কৃষকেরা খাজনা দেয় বন্ধ করে দিয়েছিল। ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের টনক নড়ে। এ ঘটনার তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের মরিস নামক এক সদস্যের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ সৈন্যসহ কুষ্টিয়ার শালঘর মধুয়ায় আসে। প্রজাদের বক্তব্য ছিল খাজনা দিতে রাজি আছি তবে নীলকরদের জুলুম থেকে রক্ষা করতে হবে সরকারকে। বক্তব্য শ্রবণ করে মরিস ফিরে যান।
১৮৬০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলার তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জে. পি গ্র্যান্ট কলকাতা থেকে কুমার নদীপথে সোনামুখী জাহাজযোগে নীল হাঙ্গামার তদন্তে পাবনা আনে। পাবনায় নীলচাষিদের সম্মেলনে গভর্নর ঘোষণা করেন ‘এখন থেকে নীলচাষ করা, না করা চাষীদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। কেউ জোরপূর্বক চাষিদের নীল চাষে বাধ্য করতে পারবে না।’ এই ঘোষনার পর অনেক কৃষক আনন্দে ইতোপূর্বে লাগানো নীলগাছগুলো কেটে নদীতে ভাসিয়ে তৃপ্তিবোধ করে। চুয়াডাঙ্গায় সিন্ধুরিয়া কনসার্ন বাংলাদেশের নীলকুঠির সচিবালয় ছিল। সেকালে কুমারখালী শালঘর মধুয়ার মৃধা ও শেখ পরিবার ভয়ানকভাবে নীলবিদ্রোহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুমারখালীর শালঘর মধুয়ার শেখ আমির বিদ্রোহী বাহিনি গঠন করে। কুষ্টিয়ার প্যারী সুন্দরী এই নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
কৃষক যুদ্ধাগণ ৬টি কোম্পানিতে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করে।
২। ২য় কোম্পানি-গোলক নিক্ষেপকারী বাহিনী।
৩। ৩য় কোম্পানি-ইটপাটকেল নিক্ষেপকারী বাহিনী।
৪। ৪র্থ কোম্পানি-কাঁচা বেলওয়ালা বাহিনী (নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনীর মস্তক লক্ষ্য করে বেল ছুঁড়ে মারা)।
৫। ৫ম কোম্পানি- কাসাঁ পিতলের থালা ও বাটি আনুভূমিকভাবে চালনা করা।
পোড়ামাটির বাসন ও পাত্র নিক্ষেপকারী বাহিনী।
৬। ৬ষ্ঠ কোম্পানি-(মহিলারা) পলো বাহিনী।
টমাস আইভান কেনির পর্ষদে যারা কর্মরত ছিল-
নায়েব-হরনাথ মিত্র।
দেওয়ান-শম্ভুচরণ মিত্র।
গাড়োয়ান-জকি।
এই কুখ্যাত কেনি তার ব্যক্তিগত ঘোড়ার নাম বিদ্রæপ করে রেখেছিলেন-প্যারীজান অর্থ্যাৎ প্যারী সুন্দরী।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা সত্যিই বিশাল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। রাজনৈতিকভাবে সমাজের সকল শ্রেণী যখন ভারতস্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তখন নারীরা কেন বসে থাকবেন? ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা এতো ব্যাপক ও গভীর ছিল যা এখন ভাবতে গেলও অবাক হতে হয়। ঊনিশ শতকের অনাচারের বিরুদ্ধে সচেতন শিক্ষিত সমাজ সোচ্চার হয়েছিল এর মধ্যে সমাজে নারীর মর্যাদা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা উল্লেখযোগ্য। নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহ পুরুষের বহু বিবাহ রোধের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯৫৭র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের ভূমিকা থেকে বিপ্লবীদের ভারতীয় স্বাধীনতার সশস্ত্র পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ও পর্যায়ে লাখ লাখ মহিলা স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশ নেন। গান্ধীর ‘লবণ আইন’ অমান্যের সময় সাধারণ গৃহবধূরা ছুটে গেছেন ওই আন্দোলনে যোগ দিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের জরুরি পরিবেশে মহিলারা নজিরবিহীন ভূমিকা পালন করেন। জাতীয় রাজনীতিতে কেবল মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাবের পরই স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ শুরু হয়নি। ঊনিশ শতকের বিভিন্ন সময় ও পর্যায়ে তাঁরাযে অংশ নেন, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।
অষ্টাদশ ও ঊনিশ শতকে আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক বিদ্রোহগুলোয় মহিলারাও সক্রিয় ছিলেন। ১৭৯৯ সালে চাউর বিদ্রোহে মেদিনীপুরের রানী এবং ১৮২৮ সালের কিত্তুরে রানীর ভূমিকা প্রবাদসমান। ঝাঁসির রানী ল²ীবাই রামগড়ের রানী এবং আউধের বেগমমহল শীর্ষ পর্যায়ের নেত্রী ছিলেন। মহারানী তপস্বিনী পÐিতা রমাবাই,স্বর্ণকুমারী দেবী, ফ্রান্সিনা সোরাবাহি দেশের বাইরে ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ট শহরে বি কাজি কামা নামে এক মহিলা ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভারতীয় নারীদের আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। রাজনীতিতে গান্ধীর নেতৃত¦ দেয়ার পরপরই মহিলারা ক্রমাগত বিপুল হারে আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন। জাতির প্রয়োজনে তারা সবকিছু ছেড়ে পথে নেমেছিলেন। কোনো কোনো সময় স্বদেশী কাজের অপরাধে মহিলাদেরকে জেলে যেতে হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনে কিছু মহিলারা যোগদান জাতীয়তাবাদের প্রতি পরিবার ও সংগঠনের নির্দেশের কারণে সহজ ছিল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনায় জড়িত কল্পনা দত্ত যোগী বৈপ্লবিক কর্মকাÐের রোমান্টিক আবেদন সম্পর্কে বলেছেন, অনেকের ধারণা তৎকালীন মহিলারা জাতীয় বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন তাদের জীবন তপস্যা কিংবা জাতীর জন্য আত্মদানের অংশ হিসেবে। কল্যাণী ভট্টাচার্য ও তার বোন বাণী দাসের জীবনে তা খুব স্পষ্ট। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি প্রসঙ্গে রেণু চক্রবর্তী ভারত স¦াধীনতার ক্ষেত্রে অনেক বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনা ব্যক্ত করেছিলেন। কত জানা অজানা মহীয়ষী নারীর আত্মত্যাগে সেদিন ভারত স¦াধীন হয়েছিল তার ইতিহাস আজও সঠিক রচিত হয়নি।
২। ভগ্নী নিবেদিতা
৩। স্বর্ণকুমারী দেবী
৪। সরলা দেবী
৫। আশালতা সেন
৬। সরোজিনী নাইড়–
৭। কল্পনা দত্ত
৮। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
৯। মাতঙ্গিনী হাজরা
১০। কস্তুরীবা গান্ধী
১১। সুচেতা কৃপালিনী
১২। প্যারী সুন্দরী
১৩। ইলা মিত্র
মূলত মোঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহের কাল থেকেই ইংরেজ রাজত্ব গোটা ভারত উপমহাদেশে মজবুত হতে থাকে।
পক্ষান্তরে সমগ্র উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ইংরেজদের প্রায় দুইশত বছর লেগে যায়। পলাশী প্রান্তওে পরাধীনতার যে বীজ সেদিন রোপিত হয়েছিল কালক্রমে তা বিরাট মহীরুহে পরিণত হলো। আর সেই বিষবৃক্ষের বিষাক্ত হাওয়ায় জ্বলতে পুড়তে বাঙালির জীবনসংগ্রামে নতুন এক ভয়াবহ বিভীষিকার উদ্ভব হয় বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬) ১৭৬৯-৭০। একদিকে খাদ্যাভাব অন্যদিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ভারতবর্ষের মানুষ তখন দিশেহারা। শুরু হলো সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, প্রায় তিন দশক ধরে এ বিদ্রোহ চলে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্ন্যাসী ও ফকিররা, এ দলের নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ ও ভবানী পাঠক।
শুরু হলো চুয়ার বিদ্রোহ, অতঃপর মেহনতী চাষির সর্বনাশ করতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বিদ্রোহে অংশ নিলেন টিপু সুলতান একে একে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতবর্ষে।
‘পলিগার বিদ্রোহ’ ওড়িষার পাইক অভ্যুত্থান। কর্ণাটকের কিট্রকের রানী চান্নান্মাও সাঙ্গোলির বায়ান্নর সংগ্রাম। তারপর হরিয়াণার কৃষক বিদ্রোহ সাঁওতাল বিদ্রোহ। ওয়াহাবি ফারাজি আন্দোলন। এককথায় নিশ্চিত যে, ইংরেজ রাজত্বের প্রথম একশো বছরের ইতিহাস অজস্র ছোটবড় বিদ্রোহে ভরপুর। ১৮৫৭ সিপাহি বিদ্রোহ এবং ১৮৯০ নীল বিদ্রোহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দেখা দেয় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ। কুষ্টিয়া যশোর পরবর্তীতে বিহারের দ্বারভাঙ্গা ও সত্তরের দশকে পাঞ্জাবের দেশপ্রেমিক শিখরা সংগঠিত করলেন ‘কুকা বিদ্রোহ’। অতঃপর সারা ভারত জুড়ে চলতে থাকে কৃষক আন্দোলন নাটা-নিয়ন্ত্রণ আইন করে ইংরেজরা আমাদের দেশপ্রেমের জাগরণে বাঁধা সৃষ্টি করতে চাইলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ অথবা ‘গাহ ভারতের জয়’ সত্যেন্দ্রন্থ ঠাকুরের এসব গান যেন বন্ধ হয় তার ব্যবস্থা নিলেন। প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘ভারতসভা’ কলকাতায়। বেশ কিছুদিন পরে বোম্বাইয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর জন্ম হয়। ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ রোধ ১৯০৬ ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম। ভারত শাসন আইন। আমেরিকা ‘গদর’ দল প্রতিষ্ঠা হোম-রুল দাবি। ১৯১৯ রাওলট আইন সত্যাগ্রহ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ দল কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা ‘সাইমন গো-ব্যাক মিছিল’। আইন অমান্য আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লণ্ঠন, গান্ধী-আরউইন যুদ্ধবিরোধী চুক্তি।
বিপ্লবী শ্রেষ্ঠ ভগবৎ সিংয়ের ফাঁসি, ১৯২৯ এর ডিসেম্বরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে গৃহীত হয় পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব, ১৯৩০ এর ২৬ জানুয়ারি সারাদেশে পালিত হলো ‘স্বাধীনতা দিবস’। গান্ধীজীর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজের জন্য শুরু হলো ‘আইন অমান্য আন্দোলন’। গান্ধীজীর অবর্তমানে ধরসোনা, লবণ গোলা দখল অভিযানে নেতৃত্বে দিলেন বাংলার নেত্রী সরোজিনী নাইডু। ১৯৩৫ দ্রুত ঘোষিত হলো প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৩৯ কংগ্রেস থেকে সুভাষ বোস বিতাড়িত ১৯৪০ এল পাকিস্তান প্রস্তাব।
১৯৪১-৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তারপর ১৯৪৬ সাম্প্রদায়িক ভাঙ্গা এবং তার পরের বছর ২রা জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত ভাগের ঘোষণা দেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হলো আন্দোলনের মধ্যেও কাঁটার মতো বিঁধে রইলো দেশ ত্যাগের বেদনা। পলাশীর আম্রকাননে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল দেড়শো বছর পর আবার লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতা, একাংশের নাম ভারত,অন্যাংশের নাম পাকিস্তান। স্বদেশী যুগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের মৌলিক তফাৎ সে কালের স্বদেশী আমলের জাতীয়তাবাদী বাঙালিরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি, তারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল। কিন্তু আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা ইতিহাসে এই প্রথম স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়েছি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চূড়ান্ত ভাবে প্রস্তুত হতে আহবান জানিয়েছেন। সমগ্র দেশবাসীকে তিনি ডাক দিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
যে পলাশীর প্রান্তরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল আবার পলাশীর নিকটবর্তী কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে নব গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশর অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ। অতঃপর ফিরে আসি নারী নেতৃত্বের অঙ্গনে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে রাজনীতিকনারী স্বীয় প্রতিভা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা ও অসমসাহসিকতার দৃঢ় স্বাক্ষর রেখেছেন রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। পুুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আজ অবধি নারীও চলেছে সমান তালে, আগামী পৃথিবীর পথে। অনেক বিজয়ী নারীর কথা আমরা জানি যাঁরা পুরুষের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, অনেকে রণাঙ্গনে আত্মহুতি দিয়েছেন, আবার কেউবা প্রাণ দিয়েছেন ফাঁসিকাষ্ঠে এবং শক্রকে নির্মূল করে যাঁরা জয়ী হয়েছিল তাঁরা পেয়েছেন স্বদেশবাসীর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। এঁদের মধ্যে অনেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন, কোনো নেত্রী ব্যর্থ হয়েছেন সেরুপ দৃষ্টান্ত বিরল। বরং তাদের সাফল্য সার্থকতার কথাই বেশি শোনা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে ১২ জন নারী যারা রাজনীতিকে খ্যাতিমান পুরুষের স্ত্রী। এই ১২ জন মহিলা হচ্ছেন-
২। ম্যামি আইজেন হাওয়ার
৩। মেরি উইলসন
৪। নাদেঝ্দা অ্যালিলুযে ভাস্তালিন
৫। নিনা ক্রুশ্চভ
৬। বেস ট্রুম্যান
৭। প্যাট নিক্রন
৮। জ্যাকি কেনেডি
৯। লেডি বার্ড জনসন
১০। এলিনর রুজভেন্ট
১১। ক্লেমেন্টাইন চার্চিল
১২। নাদেঝ্দা ক্রুপস্কায়া লেলিনপতœী
এছাড়া আরও ১২ জন বিখ্যাত নারীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এঁদের মধ্যে
১। লেডি ন্যান্সি অ্যাস্কাটর
২। লিওনর সুলিভ্যান
৩। মার্গারেট চেজ স্মিথ
৪। মার্থা গ্রিফিথ্স্
৫। এলা গ্রাসো
৬। ইন্দিরা গান্ধী
৭। শার্লি চিশলম্
৮। মার্গারেট থ্যাচার
৯। বার্নাডেট ডেভলিন
১০। গোলডা মেয়ার
১১। অং সান সু চি
১২। শেখ হাসিনা
বিপ্লবী নারীর ভুমিকায় আর ১০ জন যথা-
১। আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই
২। বোজা লুক্সেমবার্গ
৩। হালিদা এদিব
৪। ইভা ব্রযডো
৫। অ্যাঞ্জেলা ডেভিস
৬। মড গোনে
৭। একতারিনা ব্রেমকো ব্রেশকভ্স্কায়া
৮। ডোলোরেস ইবার রুবি (লাপসিওনারিয়া)
৯। চি’উ-চিন
১০। শার্লট কর্ডে
প্যারী সুন্দরীকে নিয়ে কিঞ্চিৎ নাট্যভাবনার দৃশ্যকল্প কুষ্টিয়া জেলার আমলা সদরপুর গ্রাম নাটকের পটভূমি ইংরেজ কুঠিয়ালদের নিরীহ প্রজাবর্গের উপর অত্যাচারের দৃশ্য। মুক্তাঙ্গন- কতকগুলো নিরীহ কৃষককে পিঠমোড়া করে বাঁধা। মাথার উপরে মাটির ঢিবি করে তার উপর নীলের বীজ পুতেঁ দাঁড় করিয়ে রেখেছে তপ্ত রোদে যতক্ষণ না অঙ্কুরিত হচ্ছে। একজন ইংরেজ চাবুক দিয়ে কৃষকদের পেটাচ্ছে।
ইংরেজ : দাদন নিয়েছিস নীল করবি না? শালা কুত্তার বাচ্চা।
কৃষক : সাহেব তোমার দুটো পায়ে পড়ি। আমি দাদন নিইনি। তোমার ঐ সেপাই আমাকে আমাকে জোর করে দাদনের কাগজে টিপসই করিয়ে নিয়েছে। আমার মাথার দিব্যি আমি টাকা পাইনি।
ইংরেজ : চোপ শালা কুত্তার বাচ্চা। জুতিয়ে তোর মাথা থেঁতলা করে দেব। ফের যদি মিথ্যে কথা বলবি তো একেবারে জানে মেরে ফেলব।
কৃষক : সাহেব আর আমি পারছিনে। আমার পেটে খিল ধরে গেল। একেবারে তুমি আমাকে মেরে ফেল। তোমার জুতোর লাথি আমার পেটের ভাত চাল করে দিয়েছে। তুমি আমার ভগমান; আমাকে ছেড়ে দাও। (জুতোর তলায় পেট চেপে রেখে চাবুক মারতে থাকে)।
ইংরেজ : তোকে ছেড়ে দেব। তোর ধিঙ্গি বউটা আমাকে গালি দিয়েছে। আমাকে বলে কিনা হনুমান। মাগি পোয়াতি হলে ওর পেট ফেড়ে বাচ্চা বের করে দিতাম।
কৃষক : সাহেব—
ইংরেজ : চোপ শালা বল গিয়ে তোর রানীমাকে, ইংরেজপক্ষ তাকে ক্ষমা করেছে। এই ক্ষমার মর্যাদা যদি তোর রানীমা না রাখতে পারে, তবে তার ফল শুভ হবে না। নীলচাষে যদি সে বাধা দেয় তবে তাকে ঘর থেকে টেনে বের করে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মরাব। আমি বেওয়াকে সাদি করব। হিম্মত থাকে তো তোর রানীমাকে বাইরে আসতে বল-দেখি সে কী করে তার সন্তানদের বাঁচায়।
২য় দৃশ্য
আমলা সদরপুর গ্রামের জমিদার বাড়ি। রানীমা প্যারা সুন্দরী একটি চেয়ারে বসে। সম্মুখে নিরীহ কৃষক সম্প্রদায় নতজানু বসে। রানীমার পেছনে কয়েকজন রাজকর্মচারী দণ্ডায়মান।
প্যারা সুন্দরী : আমরা ইংরেজদের আশ্রয় দিয়েছি বটে, কিন্তু আমাদের ঘরে বসে অনাচারের অধিকার ওদের দিইনি। ইংরেজদের গিয়ে বল আমার প্রজাবর্গের উপর যদি আর অত্যাচার করে-শরণাগত বলে তাদের আমি ক্ষমা করব না। তাদের সতর্ক করে বলে দে-আমাদের সন্তানেরা রণডঙ্কা বাজিয়ে আসছে।
স্বগতোক্তি (রানীমা): শুয়োরের বাচ্চা ইংরেজ। আর কোনও কথা তাদের সঙ্গে নয়। তোরা অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছিস। আমরা তোদের চরম দণ্ড দেব। বসে থাকা নিরীহ কৃষকদের মধ্য থেকে একজন উঠে দাঁড়ায়। চাকু দিয়ে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে প্রত্যেকের কপালে তিলক এঁকে দেয় এবং একমুঠ মাটি তুলে প্রতিজ্ঞা করে।
ইরফান : যতদিন এদেশ শক্রমুক্ত না হচ্ছে, ততদিন আমরা লড়ব। ইংরেজ সৈন্যদের এমন বিপাকে ফেলব যাতে পালাবার পথ না পায়। ভাতে, পানিতে, অন্ধকার রাতে সাপের কামড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হবে।
প্যারা সুন্দরী ওর হাতের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে।
প্যারী : আমি এই স্বদেশের পবিত্র ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, যতক্ষন ঐ ইংরেজ হিংস্র, পিচাশ কেনি সাহেবের মাথা আমার কাছে এনে দিতে না পারবে, ততক্ষন জল স্পর্শ করব না। অন্ন্ ভক্ষন করবো না। এমন কি আমৃত্যু আমি বদ্ধঘরে নিজেকে বন্দি কওে রাখবো। মৃত্যু হয় সেও আমার ভালো, তবুও অপদার্থের মতো ইংরেজ কুত্তাদের কাছে মাথা নত করবো না।
ইরফান : খোদার কসম-এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে আমি মাথা নত করিনি। আজ তোমাকে দেখে আমার দেহ মন অদ্ভুত শিহরণে উৎকণ্ঠিত। তুমি উতলা হয়ো না মা। তোমার পা ছুঁয়ে একবার আমায় শপথ করতে দাও। আমি রক্তের হোলি খেলব। রক্তের আল্পনা এঁকে দেব বাংলার ঘরে ঘরে। সাদা কুকুরের চামড়া দিয়ে বানাব জুতো। সেই জুতো দিয়ে ইংরেজদের মুখ থেঁতলে দেব। আমি স্থির হতে পারছি না। জাতি গেল, দেশ গেল, ধর্ম গেল, আমার মাথাটা মাটির সাথে মিশে গেল। দেখেছো মা পৃথিবীটা কেমন টলকাচ্ছে। অনুভব করছ মা বাতাসে কেমন রক্তের গন্ধ, পচা মানুষের গন্ধ (মুষ্টিবদ্ধ হাত করে) টমাস আইভান কেনি। আমি তোমার মাথা কেটে আনব। মায়ের উপর দেব অঞ্জলি। তোমার ঐ কুৎসিত মুখ।
সমবেত কৃষক সম্প্রদায় ছুটে যায় আইভান কেনির উদ্দেশ্যে। ক্রমশ রানীমা প্যারা সুন্দরীর মুখখানা পর্দার ভেসে ওঠে।
সহায়কগ্রন্থ ও তথ্যপঞ্জি
১। রাজনৈতিক নারীর অভ্যুদয়, বিটা যে কেলি ও মেরী বুটিলিয়ার, অনুবাদ: নূরুল ইসলাম খান, সম্পাদক : আফতাব হোসেন।
২। নদীয়া-কাহিনি, কমুদনাথ মল্লিক, মোহিত রায় সম্পাদিত।
৩। সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।
৪। ভারতের জোয়ান অব আর্ক বীরঙ্গনা মাতঙ্গিনী, প্রিয়নাথ জানা।
৫। ভারত বিচিত্রা, আগস্ট-২০০৫, সম্পাদক: নান্টু রায়।
——————————————————
তথ্যসূত্র: গদ্যমঙ্গল, সম্পাদনা: মতিউল আহসান, মিজান সরকার ও বিলু কবীর, প্রকাশক: সাহিত্য একাডেমি, কুষ্টিয়া, প্রকাশ কাল: ১৭ এপ্রিল, ২০১৩।